Tuesday, August 28, 2018

শরৎকাল

আমাদের স্কুলবেলায় খুব জনপ্রিয় একটা বাংলা রচনার বিষয় ছিল "তোমার প্রিয় ঋতু"। অনেকগুলো অপশনের মধ্যে এটা থাকলে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে এটাই বেছে নিত আর তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই লিখত শরৎকাল নিয়ে। কারণটা সহজ - এটা নিয়ে লেখার মালমশলা অনেক। দুর্গাপুজো তো থাকবেই, তার সঙ্গে আরও তিনটে জিনিসের উল্লেখ অনিবার্য। নীল আকাশে পেঁজা মেঘের তুলো, সবুজ মাঠে সাদা কাশ এলোমেলো আর শিউলিঝরা গাছের নিচে ঘুমিয়ে থাকা হুলো। সব মিলিয়ে বেশ জমাটি কিছু একটা দাঁড়িয়ে যেত সবসময়। তাই শরতের ওপর আমাদের অগাধ ভরসা ছিল।
বাস্তবিক শরৎ আমাদের প্রিয় ঋতু ছিল কিনা, সেটা অবশ্য গবেষণার বিষয়। লেখাপড়ার সূত্রে গরমের ছুটির পর থেকে পুজোর ছুটি পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় আমাদের কাটত ঘরছাড়া হয়ে। কলকাতা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়ার এক আবাসিক স্কুলে আমরা পড়তাম। প্রত্যন্ত এক গ্ৰামের নির্জন রাজ্যে প্রকান্ড রাজপ্রাসাদের মত ছিল সেই স্কুল। স্কুলের পেছনদিক দিয়ে চলে গেছে চক্রধরপুরগামী রেললাইন। বন্ধ‍্যা মাঠের সীমানা পেরিয়ে আমরা সেই রেললাইন স্পষ্ট দেখতে পেতাম। ভারতীয় রেলের দুয়োরানি এই রুটে তখনও স্টিম ইঞ্জিনে ট্রেন চালানোর বন্দোবস্ত ছিল। স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেনে বিজ্ঞানের জাঁকজমক নেই ঠিকই কিন্তু, রূপকথার আভাস আছে। ছোটনাগপুর মালভূমির এই অঞ্চলে বর্ষার দাপট নেই। বৃষ্টি হত না বললেই চলে। তবু মাঝেমধ্যে জলে ট‌ইটম্বুর মেঘের ছায়া পড়ত বিকেলে খেলার মাঠে। সেই মেঘলা বিকেলে যখন কোনও ট্রেন বাঁশী বাজিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে যেত, দিব্যি টের পেতাম নিজের চারপাশে একটা মনখারাপের ভারী হাওয়া। আনমনে পায়ের ফুটবল গড়িয়ে যেত ভুল ঠিকানায়।
এই বিষণ্ণ বর্ষার রেশ মুছে দিতে রূক্ষ লালমাটির বুকে সবুজের আয়োজন নিয়ে শরৎ এসে পৌছোত। সঙ্গে আসত নীল আকাশ, ভোরের শিশির, কাশের গুচ্ছ বা শিউলি ফুল। কিন্তু, সেসবের দিকে তাকানোর অবকাশ থাকত না। কারণ, শরৎ তার সঙ্গে নিয়ে আসত হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার বিভীষিকা। সে স্ফিংসের মত গ‍্যাঁট হয়ে বসে থাকত আমাদের আর পুজোর ছুটির মাঝখানে। পরীক্ষার সব প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিলে তবেই ছুটির দেশে প্রবেশের অধিকার। পরীক্ষার টেনশন তো ছিলই, তার ওপর বাংলা বোর্ডের পরীক্ষা মানেই হাতের ব‍্যায়াম। চিরকাল শুনেছি ICSE, CBSE মানেই খুচরো প্রশ্নের কারবার, দেদার নম্বর। অন্যদিকে বাংলা বোর্ড মানেই গভীর, গামবাট উত্তর, নম্বর দিতে গেলে শিক্ষকদের মনে হত জোর করে সম্পত্তি লিখিয়ে নিচ্ছি। 
বাংলা পরীক্ষায় রবি ঠাকুরের "অসন্তোষের কারণ" ছিল আমাদের ঘোর অশান্তির কারণ। রবি ঠাকুরের লেখা মানেই নামকরণ থেকে শুরু করে দাঁড়ি-কমার সার্থকতাও প্রশ্ন আসতে পারে। প্রত‍্যেকটা কথাই বাণীর থান ইঁট হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছাত্রছাত্রীদের ঘায়েল করে চলেছে। আমরা ওঁর সেই ঋণ কড়ায়-গন্ডায় শুধতাম পরীক্ষার খাতায় ওঁর সমাজচেতনাকে বিশ্লেষণ করে। আহা! সে যে কি অ্যানালিটিকাল আবর্জনা! আমাদের বাংলা শিক্ষকদের যে কি অপরিসীম সহ্যশক্তি - ওইসব পড়ে আবার নম্বর দিতেন! সেদিক থেকে ইংরেজি ভালো ছিল। কম্যুনিস্ট সরকারের আমলে বাংলা বোর্ডে ইংরেজিকে অচ্ছুত করে রাখা হয়েছিল। কাজেই, ইংরেজি ব‌ইয়ে ছিল কিছু নিকৃষ্ট গদ্য-পদ্য। বাঁধা গতে প্রশ্ন আসত আর তার উত্তর দেওয়ার সময় ভাষার ওপর দখল দেখানোর কোনও সুযোগ বা দায়িত্ব কোনওটাই থাকত না। কেলেঙ্কারি হত ইতিহাস পরীক্ষার দিন। পাতার পর পাতা লিখে কাশীদাসী মহাভারত সাইজের কিছু একটা বানিয়ে পরীক্ষকের ওপর ছুঁড়ে না মারতে পারলে স্বস্তি নেই। আশপাশ থেকে কাউকে বাড়তি পাতা নিতে দেখলেই প‍্যালপিটেশন। পরীক্ষার শেষে দশ-কুড়িটা বাড়তি পাতা লেনেওয়ারার মধ্যে দাঁড়িয়ে যে মাত্র চারটে বাড়তি পাতা নিয়েছে, তার চোখেমুখে ফেল করার আতঙ্ক। একবার প্রশ্ন পেয়েছিলাম - আলাউদ্দিন খিলজির শাসনব্যবস্থা। আমি হতবাক।পদ্মিনীর সঙ্গে ইন্টু-পিন্টু ছাড়া ওঁর আর কোনও ব্যাপারে যে কারোর উৎসাহ থাকতে পারে, এটা আমি কেন, খিলজী নিজেও বিশ্বাস করতেন না। এদিকে পড়ে গেছি শেরশাহের শাসনব্যবস্থা। কি করি - শুধু নাম বদলে হুবহু এক উত্তর লিখে দিলাম। ঐ উত্তর পড়লে খিলজীর চোখে জল এসে যেত - ভাবীকালের কাছে এতখানি সম্মান উনি নিজেও আশা করেন নি। ভূগোল ছিল আমার ব্যক্তিগত গোলমালের জায়গা। ম‍্যাপ পয়েন্টিংয়ে একমাত্র ভরসা কন্যাকুমারী। আইসল্যান্ড থেকে আন্টার্কটিকা - শিল্পবিকাশের একটাই কারণ - "সুলভ শ্রমিক"। নব্বইয়ের দশকে যখন কাশ্মীরে প্রবল জঙ্গিহানা, সেই সময় একবার পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল "পাকিস্তানের শিল্পবিপ্লব"। আজও জানি না, প্রশ্নটার মধ্যে কতখানি শ্লেষ ছিল।
এভাবে যেনতেন করে সব বাধা উতরে শেষমেষ এসে ঠেকতাম অংক পরীক্ষায়। কেশব নাগ ছেলেবেলায় বোধহয় কখনো "প্রিয় ঋতু" রচনায় শরৎকালের সম্বন্ধে লিখে কম নম্বর পেয়েছিলেন। রাগে-দুঃখে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিল বড় হয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের শরৎকাল ছারখার করে দেবেন। এই প্রতিভাবান শিশু বড় হয়ে অক্ষরে অক্ষরে নিজের কথা রেখেছিলেন। তার ফলে আমরা হতভম্ব হয়ে বসে থাকতাম এই জাতীয় পাটিগণিতের সামনে - "রামের স্ত্রী শ্যাম অপেক্ষা ৩ বৎসরের বড় তবু, আজ হ‌ইতে ৭ মাস ১৫ দিন আগে শ‍্যাম তাহার প্রেমে পড়িল। ফলস্বরূপ, ৪ মাস ১৭ দিন পূর্বে রাম জানিতে পারিল সে বাবা হ‌ইতে চলিয়াছে। এখন, রামের সন্তান যদি নির্দিষ্ট দিনের ২৯ দিন আগে জন্মায় তবে সেই প্রিম্যাচিওর শিশুর জন্মদিন কবে?" এছাড়াও চৌবাচ্চার দুটো নল‌ই একসঙ্গে খুলে রাখার আহাম্মকি থেকে শুরু করে, অসাধু ফল ব‍্যবসায়ীর লাভক্ষতির কেচ্ছা কিংবা ক'মাইল যেতে কোন চাকা কতবার ঘুরবে - এইসব ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যখন পরীক্ষার হল থেকে বেরোতাম, তখন শিউলি-কাশ নয়, চোখের সামনে শুধুই সর্ষেফুল। তবু সেদিন বিকেলটা বড় মোহময় লাগত। স্কুলের পাশে বরাকর রোডের ওপর দিয়ে যখন দূরপাল্লার বাসের হর্ণে স্পষ্ট শুনতে পেতাম আগমনীর সুর। কারণ, অঙ্ক পরীক্ষা শেষ হলেই হাফ-ইয়ারলি শেষ, পিতৃপক্ষ‌ও।তারপর রাত ফুরোলেই ম‍্যাজিক।
চণ্ডীপাঠের আধ্যাত্মিক প্রভাবের কথা বলতে পারব না কিন্তু, পুরো স্কুলজীবন এবং তার পরেও মহালয়ার ভোরে "মহিসাসুরমর্দিনী" শুনতে শুনতেই চিরকাল শরতের আগমন টের পেয়েছি। আমাদের স্কুল ছিল শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে। মহালয়ার সকালে আমাদের গা ছুঁয়ে যেত এক অন্যরকম হাওয়া। নীল আকাশে চোখ মেললে দেখতে পেতাম সাদা তুলোর মেঘ। মাঠে মাঠে কাশফুলের সমুদ্র। এখন অবশ্য আর সেসবের বালাই নেই। মাথার ওপর এখন বারোমাস দূষিত, ধুসর আকাশ। এগারো মাস গরম, সময়-অসময়ে বৃষ্টি। খুব বেশি হলে, একমাসের জন্য গায়ের ওপর সোয়েটার, মাফলার। শহুরে "সভ্যতা"র দানে সব ঋতু তালগোল পাকিয়ে একাকার। তবু, কংক্রিটের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে নিঃসঙ্গ মাঠে এখনও কিছু অবাধ্য, উদ্ধত কাশের গুচ্ছ মাথা তোলে। আর আশ্বিনের ভোরে এখনও শুনি "মহিষাসুরমর্দিনী"। তখন বুঝতে পারি শরৎ এসেছে, পুজোও এলো ।।